- Published on
এআই এর বিদ্যুতের ব্যবহার: উদ্বেগ এবং চ্যালেঞ্জ
এআই এর বিদ্যুতের ব্যবহার: একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে, এই দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসছে – তা হলো এর বিশাল বিদ্যুৎ consumption বা বিদ্যুতের ব্যবহার। কেউ কেউ রসিকতা করে বলেন, যখন বিদ্যুতের দাম রুটির চেয়ে বেশি হবে, তখনই হয়তো এআই মানুষের স্থান পুরোপুরি দখল করতে পারবে না। এই রসিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি গভীর বাস্তবতা: উচ্চ বিদ্যুৎ খরচ এআই-এর বিকাশের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গুগলের প্রাক্তন প্রকৌশলী কাইল কোবিট সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে, মাইক্রোসফট তাদের GPT-6 মডেল প্রশিক্ষণের সময় বিদ্যুতের সমস্যায় পড়েছিল। এই ঘটনাটি এআই এর বিদ্যুৎ ব্যবহারের চ্যালেঞ্জের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
প্রশিক্ষণ মডেলে বিদ্যুতের চাহিদা
বৃহৎ এআই মডেলগুলির প্রশিক্ষণের জন্য, মাইক্রোসফটের প্রকৌশলীরা ইনফিনিব্যান্ড নেটওয়ার্ক তৈরি করতে কাজ করছেন। এই নেটওয়ার্ক বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ)-গুলিকে সংযুক্ত করে। কাজটি জটিল, কারণ একটি অঞ্চলে যদি 100,000টির বেশি H100 চিপ স্থাপন করা হয়, তবে স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রিড ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য, আসুন একটি সাধারণ হিসাব করি। এনভিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি H100 চিপের সর্বোচ্চ ক্ষমতা 700 ওয়াট। তাহলে, 100,000 চিপের সম্মিলিত ক্ষমতা হবে 70 মিলিয়ন ওয়াট। জ্বালানি শিল্পের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিমাণ বিদ্যুৎ একটি ছোট সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদনের সমান। এছাড়াও, আমাদের সার্ভার এবং কুলিং সিস্টেমের মতো সহায়ক সরঞ্জামগুলির বিদ্যুতের ব্যবহারও বিবেচনা করতে হবে। এই সমস্ত সরঞ্জাম একটি ছোট অঞ্চলে একত্রিত হলে, বিদ্যুৎ গ্রিডের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।
এআই বিদ্যুতের ব্যবহার: হিমশৈলের চূড়া মাত্র
নিউ ইয়র্কারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চ্যাটজিপিটি প্রতিদিন প্রায় 500,000 কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। যদিও, বর্তমানে এআই এর বিদ্যুৎ ব্যবহার ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ঐতিহ্যবাহী ডেটা সেন্টারগুলোর তুলনায় কম। মাইক্রোসফটের প্রকৌশলীদের সমস্যাগুলো প্রমাণ করে যে, এআই এর বিকাশে শুধু প্রযুক্তিগত দিক নয়, বরং অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ গ্রিডের ধারণক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি মিলিয়ে ৪৬০ টেরাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ২%। আইইএ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে এই খাতের বিদ্যুৎ ব্যবহার ১০০০ টেরাওয়াট ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারে, যা জাপানের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান।
বর্তমানে, এআই গবেষণায় সরাসরি ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ডেটা সেন্টার এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির তুলনায় কম। এনভিডিয়া এআই সার্ভার বাজারে প্রধান অবস্থানে রয়েছে এবং ২০২৩ সালে প্রায় 100,000 চিপ সরবরাহ করেছে, যার বার্ষিক বিদ্যুৎ ব্যবহার প্রায় 7.3 টেরাওয়াট ঘণ্টা। এর বিপরীতে, ২০২২ সালে ক্রিপ্টোকারেন্সির বিদ্যুৎ ব্যবহার ছিল 110 টেরাওয়াট ঘণ্টা, যা নেদারল্যান্ডের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান।
কুলিং বা শীতলীকরণ: একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ডেটা সেন্টারের কার্যকারিতা সাধারণত পাওয়ার ইউসেজ ইফেক্টিভনেস (পিইউই) দ্বারা পরিমাপ করা হয়। পিইউই হলো ব্যবহৃত মোট শক্তি এবং আইটি লোড দ্বারা ব্যবহৃত শক্তির অনুপাত। পিইউই-এর মান ১ এর যত কাছাকাছি, ডেটা সেন্টার তত কম শক্তি অপচয় করে। আপটাইম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী বড় ডেটা সেন্টারগুলোর গড় পিইউই ছিল প্রায় ১.৫৯। এর মানে হলো, ডেটা সেন্টারের আইটি সরঞ্জাম প্রতি ১ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য, সহায়ক সরঞ্জামগুলো ০.৫৯ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।
ডেটা সেন্টারের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের একটি বড় অংশ কুলিং বা শীতলীকরণ সিস্টেমে ব্যয় হয়। গবেষণা থেকে জানা যায়, কুলিং সিস্টেম ডেটা সেন্টারের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ৪০% পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে। চিপগুলোর ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে, একক ডিভাইসের ক্ষমতা বাড়ছে, ফলে ডেটা সেন্টারের পাওয়ার ডেনসিটিও বাড়ছে। এতে করে ডেটা সেন্টারগুলোতে আরও উন্নত কুলিং সিস্টেমের প্রয়োজন হচ্ছে। তবে, ডেটা সেন্টারের নকশা উন্নত করে বিদ্যুতের অপচয় কমানো সম্ভব।
বিভিন্ন ডেটা সেন্টারের পিইউই মান ভিন্ন হতে পারে, যা কুলিং সিস্টেম এবং কাঠামোগত নকশার উপর নির্ভর করে। আপটাইম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপীয় দেশগুলোতে পিইউই-এর মান ১.৪৬ এ নেমে এসেছে, যেখানে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে এখনও ১০% এর বেশি ডেটা সেন্টারের পিইউই মান ২.১৯ এর বেশি।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বড় ডেটা সেন্টারগুলোতে অতিরিক্ত তাপ পুনরুদ্ধার করার সরঞ্জাম স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। মার্কিন সরকার আরও দক্ষ সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। চীন সরকারও ২০২৫ সাল থেকে ডেটা সেন্টারগুলোর পিইউই ১.৩ এর নিচে রাখার এবং ২০৩২ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ১০০% এ উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবহার: সমস্যা ও সমাধান
ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং এআই-এর বিকাশের সাথে সাথে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ডেটা সেন্টারের আকার ক্রমাগত বাড়ছে। আইইএ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২৭০০টি ডেটা সেন্টার ছিল, যা দেশের মোট বিদ্যুতের ৪% ব্যবহার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যে এই হার ৬% এ পৌঁছাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে জমির অভাবের কারণে, ডেটা সেন্টারগুলো ধীরে ধীরে মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তরিত হচ্ছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত নাও থাকতে পারে।
কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি বিদ্যুৎ গ্রিডের উপর নির্ভরতা কমাতে সরাসরি ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার চেষ্টা করছে, তবে এর জন্য জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। মাইক্রোসফট এআই ব্যবহার করে এই প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে গুগল এআই ব্যবহার করে কম্পিউটিং টাস্ক শিডিউল করছে, যাতে গ্রিডের কার্যকারিতা বাড়ে এবং কার্বন নিঃসরণ কমে। তবে, নিয়ন্ত্রিত ফিউশন কবে নাগাদ ব্যবহার করা যাবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
জলবায়ু পরিবর্তন: একটি অতিরিক্ত চাপ
এআই-এর বিকাশের জন্য স্থিতিশীল এবং শক্তিশালী বিদ্যুৎ গ্রিড প্রয়োজন, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক অঞ্চলের বিদ্যুৎ গ্রিড দুর্বল হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি আরও ঘন ঘন ঘটছে, যা বিদ্যুতের চাহিদা বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি বিদ্যুৎ গ্রিডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। আইইএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খরা, কম বৃষ্টিপাত এবং তুষার দ্রুত গলে যাওয়ার কারণে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী জলবিদ্যুৎ উৎপাদন গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা ৪০% এরও কম।
প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের একটি মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়, তবে শীতকালে চরম আবহাওয়ায় এর স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ২০২১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে তীব্র শীতের কারণে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছিল, যেখানে কিছু বাসিন্দা ৭০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎবিহীন ছিল। এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন জমে যাওয়া, যার কারণে প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
উত্তর আমেরিকার বিদ্যুৎ নির্ভরযোগ্যতা কাউন্সিল (এনইআরসি) পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০২৪-২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঝুঁকিতে থাকবে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে, অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে একটি অন্তর্বর্তী সমাধান হিসেবে বিবেচনা করছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ ২৮), ২২টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০২০ সালের তুলনায় ৩ গুণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই সাথে, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণে জোর দেওয়ায়, আইইএ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
আইইএ-এর প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, "পরিবর্তনশীল জলবায়ুর পরিস্থিতিতে, জ্বালানির বৈচিত্র্য বাড়ানো, বিদ্যুৎ গ্রিডের আন্তঃআঞ্চলিক সমন্বয় উন্নত করা এবং আরও স্থিতিশীল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।" বিদ্যুৎ গ্রিডের অবকাঠামো রক্ষা করা শুধু এআই প্রযুক্তির বিকাশের জন্যই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।